16/04/2025
বিড়াল কীভাবে আমাদের ঘরের সঙ্গী হলো?
প্রাচীন মিশরের ধর্মীয় উৎসর্গ, ভালোবাসা আর বিড়ালের অদ্ভুত এক যাত্রা
বিড়াল আমাদের জীবনের অংশ কবে থেকে? অনেকদিন ধরেই ধারণা ছিল, প্রাচীন মিশরেই বিড়াল গৃহপালিত হয়। মিশরের বিড়াল-মমি আর শিল্পকর্ম যেন সে ইতিহাসের সাক্ষ্য। কিন্তু ২০০১ সালে সাইপ্রাসে এক ৯৫০০ বছর পুরোনো কবর খুঁজে পায় প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। সেখানে এক মানুষের পাশে এক বিড়ালের দেহাবশেষ! এ আবিষ্কার যেন মিশরের দাবিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলো—কারণ এই বিড়াল মিশরের ইতিহাসেরও ৪০০০ বছর আগের।
এই অনুসন্ধান ও ইউরোপজুড়ে আরও কিছু বিড়ালের হাড়ের সন্ধান পাওয়ার পর বিজ্ঞানীরা ভাবতে শুরু করলেন—বোধহয় বিড়ালকে মানুষ পোষ মানিয়েছিল আরও আগে, মধ্যপ্রাচ্যে বা তুরস্ক অঞ্চলের কৃষক গ্রামগুলোতে। সেখান থেকে কৃষকেরা তাদের বিড়াল বন্ধুদের সঙ্গে করে ইউরোপে নিয়ে যান।
তবে সাম্প্রতিক দুটি গবেষণা গল্পটা আবার ঘুরিয়ে দিল। এগুলো জানাচ্ছে—গৃহপালিত বিড়ালের প্রকৃত সূচনা হয়তো মিশরেই, আর তাও মাত্র ৩০০০ বছর আগে। এখানেই আসে এক ব্যতিক্রমী তত্ত্ব—প্রাচীন মিশরে ধর্মীয় উৎসর্গের জন্য লাখ লাখ বিড়াল পালিত ও বলি দেওয়া হতো। এই বলির মধ্যেই ধীরে ধীরে বিড়ালদের মধ্যে জন্ম নেয় মানুষের সান্নিধ্য সহ্য করার ক্ষমতা। একে বলা হচ্ছে “হত্যার পথ”—তবে এটি ছিল একটি বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া, না যে একবারেই ঘটে গেছে।
গবেষক গ্রেগার লারসনের ভাষায়, বিড়ালদের ওপর তখন তীব্র সামাজিক চাপ তৈরি হয় মানুষের সঙ্গে মানিয়ে নিতে। এভাবে যারা তুলনামূলকভাবে শান্ত, তারা টিকে থাকত, প্রজনন করত—অন্যরা নয়। এক পর্যায়ে এই বিড়ালরা শুধুই বলির পশু না থেকে, হয়ে ওঠে পরিবারের সদস্য।
তবে এটি পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। সাইপ্রাসে পাওয়া বিড়ালের হাড় পরীক্ষা করে দেখা গেছে—তা আসলে ছিল ইউরোপীয় বন্য বিড়াল, গৃহপালিত নয়। অনেক জায়গায় এমন হাড় পাওয়া গেছে যেখানে আশেপাশে কোনো মানুষের বাসস্থানও ছিল না। ডিএনএ বিশ্লেষণ বলছে, বিড়ালগুলো ছিল প্রকৃত বন্য।
এইসব তথ্য জানাচ্ছে, ইউরোপে গৃহপালিত বিড়ালের উপস্থিতি হয়তো ভুল বোঝাবুঝি ছিল। বরং গৃহপালনের সত্যিকারের শিকড় হয়তো মিশরেই।
প্রমাণ হিসেবে গবেষকেরা দেখান, মিশরে পাওয়া বিড়ালের মমিগুলো, যেগুলোর বয়স ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত পুরোনো, তাদের ডিএনএ মিলে যায় উত্তর আফ্রিকার বন্য বিড়ালের সঙ্গে। সময়কালটাও মিলে যায়—এ সময়ই বিড়ালদেবী বাসতেতের উপাসনা চরমে পৌঁছায়। প্রথমে সিংহমুখী দেবী হিসেবে পূজিত হলেও পরে তিনি বিড়ালমুখী রূপে আরাধিত হন।
ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে মানুষ মন্দিরে বিড়াল উৎসর্গ করত। এ জন্য মিশরে গড়ে ওঠে “ক্যাটারি”—বিড়াল পালনের খামার। লক্ষ লক্ষ বিড়াল মমি করা হয়। এমনকি ১৯শ শতকে এত বিড়াল-মমি পাওয়া যায় যে সেগুলো ইংল্যান্ডে নিয়ে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল!
এভাবে একসাথে অসংখ্য বিড়াল পালনের দরকার হলে, যে বিড়ালগুলো সবচেয়ে পোষ মানতো—তারাই বেশি সংখ্যায় বাঁচত ও বংশবিস্তারে সফল হতো। এভাবেই গড়ে ওঠে গৃহপালিত বিড়ালের প্রথম প্রজাতি।
তবে প্রাচীন মিশরের বিড়ালের গল্প শুধু বলি-উৎসর্গে সীমাবদ্ধ ছিল না। অনেক আগেই, অর্থাৎ প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে, চিত্রকলায় দেখা যায় বিড়াল ঘরের ভেতরে আছে, টেবিলের নিচে বসে মাছ খাচ্ছে। আবার আরও আগেও (৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বিড়ালের হাড় পাওয়া গেছে কবরস্থানে। এর মানে, বিড়াল অনেক আগেই মানুষের জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল।
মিশরতত্ত্ববিদ জুলিয়া ট্রোশে মনে করেন, বিড়াল আর মানুষের বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল একদম বাস্তব প্রয়োজনে—ঘরে রাখা শস্যে ইঁদুর আসত, আর সেই ইঁদুর ধরতে বিড়াল। তারপর ধীরে ধীরে সম্পর্কটা গাঢ় হয়। শান্ত স্বভাবের বিড়াল ঘরে ঢুকে পড়ে, মানুষ তাদের সহ্য করে, তারপর স্নেহ করে, আর এভাবেই পোষ মানতে শুরু করে।
এরপর রোমানরা বিড়ালকে ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে দেয়। অস্ট্রিয়ায় পাওয়া এক প্রাচীন বিড়ালের বয়স ৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, অর্থাৎ রোমান আমলেই বিড়াল ছড়িয়ে পড়ছিল।
আজ পৃথিবীতে প্রায় এক বিলিয়ন বিড়াল আছে, যারা ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর প্রায় সব কোণায়।
আর এ যাত্রার শুরুতে ছিল এক অদ্ভুত সমীকরণ—ধর্ম, খাদ্য, পরিবেশ আর ভালোবাসা।
ট্রোশে বলেন,
"কিছু একটা বিশেষ ছিল বিড়ালের মধ্যে—শুধু এ কারণে নয় যে ওরা এত আদুরে আর মিষ্টি!"
সূত্র: Science. org
#বিজ্ঞান_চর্চা_কেন্দ্র